খেলাফতের গুরুত্ব ও কল্যাণ – Blessings and Importance of Khilafat

/, Khilafat/খেলাফতের গুরুত্ব ও কল্যাণ – Blessings and Importance of Khilafat

খেলাফতের গুরুত্ব ও কল্যাণ – Blessings and Importance of Khilafat

খেলাফতের গুরুত্ব ও কল্যাণ – Blessings and Importance of Khilafat
মুসলিম জাহান আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত আজ সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের শিকার হয়ে বিধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। সমস্ত মুসলিম আজ শতধা বিভক্ত হয়ে পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের মাঝেই নেই ঐক্য। মুসলমানদের এই অনৈক্যের কারণেই ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করছে না। সর্বত্রে মুসলমানরা আজ মার খাচ্ছে, এর কারণ কি? শ্রেষ্ঠ নবীর, শ্রেষ্ঠ উম্মতের এই চরম অধঃপতন ও বিপর্যয় তো কখনো কাম্য হতে পারে না। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের এই চরম বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ হলো তাদের আজ কোন ঐশী নেতা নেই। মুসলিম জাহান আজ নেতৃত্ব শূন্য অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে যার ফলেই এই অধঃপতন।

হযরত মুহাম্মদ মুস্তোফা (সা.) বিশ্ববাসীকে ধ্বংস ও পতন থেকে রক্ষা করে পূণ্যের পথে চালিত করার জন্যেই এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। তিনি ঐশী নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য স্বীকার করে একতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ভ্রার্তৃত্বের সেতুবন্ধন সুদৃঢ়তর করে প্রগতির পথে চলতে বলেছেন। আজ সমগ্র মুসলিম জাহান কোন্ পথে চলছে? প্রিয় নবী (সা.) এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে ঐশী খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। সতকর্মশীল মু’মিনদের সঙ্গে মহান আল্লাহ এই খেলাফত ব্যবস্থা কায়েমেরই অঙ্গীকার করেছেন।

শুরুতেই আমি পবিত্র কুরআনের সুরা নূরের ৫৬ নং আয়াতের উল্লেখ করতেছি এখানে মহান আল্লাহ খেলাফতের ওয়াদা করেছেন। তিনি এই ওয়াদা করেছেন যে, যারা ঈমান আনে ও পূণ্য কাজ করে তাদের মাঝে তিনি খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করবেন, যেমন তিনি খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে। আমরা জানি, মহানবী (সা.)এর লাশ মোবারকের দাফন কার্য সমাধা করবার পূর্বেই উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সম্মিলিতভাবে হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.)কে খলীফা মেনে নিয়ে তাঁর হাতে বয়াত গ্রহণ করেছিলেন। এ আধ্যাত্মিক ঘটনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, ইসলামে খেলাফতের গুরুত্ব কত ব্যাপক। মু’মিনদের জন্য নবুওয়াতের পর যে বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য তা হচ্ছে খেলাফত। ধর্মীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, আল্লাহ্ তা’লা সকল নবীর পরেই খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খেলাফত ছাড়া ঐশী নবীর কাজ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তাই নবী-রাসূলরা যে মহান দায়ীত্ব নিয়ে এই পৃথিবীতে আগমন করেন, তাঁদের এই মহান দায়ীত্ব ও উদ্দেশ্যকে চূড়ান্ত বিজয়ে পৌঁছান আল্লাহ মনোনীত নবীর খলীফাগণ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, অগণিত স্থানে মহান খোদা তা’লা এই খেলাফতের কথা উল্লেখ করেছেন। খেলাফত সম্পর্কে এত স্পষ্টভাবে বলা এটাও প্রমাণ করে ইসলামে খেলাফত একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কারা মু’মিন এবং কারা মু’মিন নয় বা কারা সত্যিকারের ঈমানদার তা পরীক্ষা করার নিমিত্তে খেলাফত ব্যবস্থা একটি ঐশী মানদন্ড।

মহানবী (সা.) বলেছেন, “সুম্মা তাকুনু খিলাফাতুন আলা মিনহাজিন নবুওয়ত” অর্থাৎ নবুওয়তের পদ্ধতিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। (মুসনাদ আহমদ, মিশকাত)। সূরা নুরের ৫৬ নম্বর আয়াত এবং মহানবী (সা.)-এর এই হাদিস দ্বারা বিষয়টি পরিষ্কার যে, আল্লাহ্ তা’লা ঈমান আনয়নকারী ও পূণ্যকর্মকারীদের মাঝে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন। অর্থাৎ উম্মতে মুহম্মদীয়া যখন কুরআনের শিক্ষার ওপর সঠিকভাবে আমল করবে তখন আল্লাহ এ অঙ্গীকার পূর্ণ করবেন। আর তখন রসূল করীম (সা.)-এর কথা মত নবুওয়তের পদ্ধতিতে খেলাফত ব্যবস্থা জারী হবে। আর আজ তা-ই আহমদীয়া জামা’তে বিদ্যামান রয়েছে। খলীফার মাধ্যমে মুসলমানরা এক আল্লাহর ইবাদত করে এবং সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এমনভাবে আবদ্ধ করেন যেন মনে হয় সবাই ভাই-ভাই। এছাড়া সমগ্র বিশ্বের ধনী দরিদ্র, সবল-দূর্বল, শিক্ষিত অশিক্ষিত জনগণকে এক সাধারণ যোগসূত্রে গ্রথিত করে প্রগতিশীল জাতিতে সংঘবদ্ধ করার জন্য ঐশী নেতৃত্বের অতি প্রয়োজন। বিভেদ বা সংঘাত নয়, সত্য প্রতিষ্ঠা এবং একক নেতৃত্বের অধীনে থেকে জীবন অতিবাহিত করার শিক্ষাই পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বার বার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম শান্তি ও ঐক্যের ধর্ম। ঐক্য প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইসলামে খেলাফতের গুরুত্ব যে অপরিসীম এই ব্যাপারে সকল যুগের জ্ঞানী-গুনি, পন্ডিত ব্যক্তিবর্গরা তাদের মতামত পেশ করেছেন। সকলেই অকপটে শিকার করেছেন যে, ঐক্য ছাড়া ইসলামের উন্নতি হতে পারে না। ইসলামের উন্নতির জন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক আর এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা কিভাবে হবে? তা হতে পারে একমাত্র ঐশী খেলাফতের অধিনে চলে জীবন অতিবাহিত করার মাধ্যমেই। বহু পূর্ব থেকেই ইসলামে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে অনেকেই অনেক আন্দোলন, চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ সাব্যস্ত হয়েছে। দেখা যায়, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় পৃথকভাবে যে আরব-ঐক্য গড়ে ওঠেছিল, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে তা-ও নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষতঃ -এর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে যে অতি প্রয়োজনীয় একক নেতৃত্ব কিংবা নেতৃত্বের ঐক্য গড়ে উঠবার সম্ভাবনা অনেকেই দেখেছিলেন তা-ও ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন আবারও নতুন করে দেখা দিয়েছে, কীভাবে মুসলিম ঐক্য গড়ে উঠবে, এই প্রশ্ন আজ সব মুসলমানেরই মনে, হোক সে সুন্নী বা শিয়া, মাযহাবী বা লা-মাযহাবী অথবা ওয়াহাবী যে-ই হোক না কেন সবাই আজ উপলব্ধি করছেন, ইসলামে একক নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তারা জানে না যে, ঐশী খেলাফত কারো চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নয়। এটি কেবল মাত্র আল্লাহ তা’লা প্রতিষ্ঠা করেন।

হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহে:) একবার বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, “সমগ্র মুসলিমবিশ্ব সম্মিলিতভাবে শক্তি ও বল প্রয়োগ করে (যদি পারে) খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে দেখাতে পারে। তারা পারবে না। কারণ খেলাফতের সম্পর্ক আল্লাহ্র ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ্ তা’লা খলীফা হিসাবে এমন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেন যাকে তিনি তাকওয়াশীল মনে করেন।” (জুমুআর খুতবা, ২ এপ্রিল, ১৯৯৩)

মানবীয় প্রচেষ্টায় যে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ঐতিহাসিকভাবেও এটা সত্য। বর্তমানও খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যারা তথাকথিত আন্দোলন করছেন তাদেরও যে একই পরিণতি দেখতে হবে সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায়। সমগ্র বিশ্ববাসীই আজ হারে হারে টের পাচ্ছে খেলাফতের প্রয়োজন যে ইসলামে অতিব্যাপক। পৃথিবীতে আজ এমন কোন দেশ নেই, এমন কোন জাতি নেই যারা বলবে না যে একক নেতার প্রয়োজন নেই। মস্তক বিহীন দেহের যেমন কোন মূল্য নেই, তেমনি খলীফা বিহীন মুসলমান জাতিরও আল্লাহর দরবারে কোন মূল্য নেই। আমরা সকলেই জানি, শরীয়তের বিধান অনুসারে ‘খলীফা’ নির্বাচন করা মুসলমানের জন্য অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। কেননা খলীফা বিহীন ইসলাম, কর্ণধারবিহীন তরীতুল্য। বিপন্ন ও লক্ষ্যভ্রষ্ট। তাই সঠিক রাস্তা দেখিয়ে মঞ্জিল পর্যন্ত পৌঁছানোই হল খলীফার কাজ। খলীফা ছাড়া আমরা সেই মঞ্জিল বা লক্ষ্য স্থলে কোনমতেই পৌঁছতে পারবো না।

ইসলামের পরিপক্কতা তখনই প্রকাশ পায় যখন এর মাঝে একক নেতৃত্ব বিদ্যমান থাকে। নবী রসূল আসেন মানুষকে ইমানদার ও খোদার হুকুম পালনকারী বান্দা বানানোর জন্য। নবী যে সব কাজ মানুষের কল্যাণের জন্য করেন, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন খলীফা। এজন্য নবীর ইন্তেকালের পর আল্লাহ্ তাঁর অনুগত বান্দাদের মধ্যে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করেন। আর এই খলীফা বানানো স্বয়ং আল্লাহর কাজ। কারণ মানুষ খলীফা নিযুক্ত করলে, সে মানুষেরা আল্লাহর সাহায্য পাবে কিভাবে? আল্লাহ এ ব্যবস্থা রেখেছেন যে, নবী রাসূলগণের রূহানী সত্তা বা রূহানী ফয়েয যেন পৃথিবীর ঈমানদার মানুষের মধ্যে বিরাজমান থাকে।

সৌর জগতে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্ররাজি যেভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে আপন আপন কক্ষে ঘূর্ণীয়মান করে এক মহান দায়িত্ব পালন করে ও স্বকীয়তা বজায় রাখে, তদ্রুপ মানব মন্ডলীও সমসাময়ীক ঐশী ইমামের পরিচালনায় এক সবল, সতেজ সংগঠনে একত্রিত হয়ে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করে মরুজগতেও স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারে।

খেলাফত এমন এক ঐশী ব্যবস্থাপনা যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লার তৌহিদ প্রতিষ্ঠা হয়। খেলাফত ছাড়া প্রকৃত অর্থে আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়া কখনো সম্ভব নয়। যেখানে খেলাফত এমন এক ঐশী ব্যবস্থাপনা যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লার তৌহিদ প্রতিষ্ঠা হয়। খেলাফত ছাড়া প্রকৃত অর্থে আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়া কখনো সম্ভব নয়। যেখানে খেলাফত নেই সেখানে তৌহিদ প্রতিষ্ঠা হতেই পারে না। একমাত্র খেলাফতের মাধ্যমেই সম্ভব তৌহীদ প্রতিষ্ঠা করা। কারণ পবিত্র কুরআনে (সুরা নূরের ৫৬) এই সম্পর্কে বলেন, “ইয়া’বুদুনানি লা ইউশরিকুনা বি শাইআ” অর্থাৎ তারা আমার ইবাদত করবে এবং কোন বস্তুকে আমার সাথে শরীক করবে না। এখানে আল্লাহ্ তা’লা এটাই স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন, যারা খেলাফতের রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে তারা কোন দিন শিরক করবে না, তারা এক খোদার ইবাদতে নিমগ্ন থাকবে, তারা আল্লার তৌহীদ প্রতিষ্ঠাকারী হবে। আর যাদের মাঝে এই খেলাফত থাকবে না তারা আল্লাহর তৌহীদ থেকে দূরে সরে যাবে। যেমন আজ আমরা খেলাফতহীন দলগুলোর মাঝে দেখতে পাই নানা ধরনের শিরিক। যা দেখে খুবই আফসোস হয়, হায়রে মুসলমান! কত উচ্চ শিক্ষা ইসলামের, আর আজ না বুঝার কারণে কোন পর্যায়ে নেমেছে। পীরপূজা, কবর পূজা, আগুন পূজা, গাছ পূজা ইত্যাদি হরদমে চলছে। একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, যতদিন পর্যন্ত সমস্ত বিশ্ব ইসলামী খেলাফতের অধীনে না আসবে ততোদিন পর্যন্ত শিরিক -এর প্রাধান্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে। খেলাফতই হল একমাত্র মাধ্যম আল্লাহর তৌহীদ প্রতিষ্ঠা করার। এ ছাড়া আর কোন মাধ্যম আল্লাহ রাখেননি। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর তৌহীদ প্রতিষ্ঠার লক্ষে নেযামে খেলাফতের রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আকড়েঁ ধরা। আর এরফলেই আমরা শির্ক মুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে পারবো। খোদার নৈকট্য অর্জন করতে হলে একতা আবশ্যক। আমরা রসূল করীম (সা.)-এর জীবনের দিকে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই ইসলামের বিজয় এনে দিয়েছিল কেবল একক নেতৃত্বের কারণেই। ঐশী নেতার প্রতি সাহাবাদের প্রবল আনুগত্যই হাজার হাজার মুশরিকদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করার প্রধান কারণ ছিল। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পরও আমরা একক ইসলামী খলীফার নেতৃত্বে সমগ্র বিশ্ব পরিচালিত হতে দেখেছি। আর এক খলীফার আনুগত্যর ফলেই সাহাবীরা আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য লাভ করতে পেরেছিলেন এবং আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও তাদের মান ছিল চরম পর্যায়ের। তাই নিঃসন্দেহ বলা যায়, কোন জাতি আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে হলে খলীফার প্রয়োজন সর্বপ্রথম।

ইসলামী ঐশী খেলাফতের মর্যাদা ও গুরুত্বকে উপলব্ধি করে খোদা তা’লার নির্দেশে আহমদীয়া জামা’তে খেলাফত ব্যবস্থা পুনরায় জারি হয়। ক্ষুদ্র ও দুর্বল একটি জামা’তের মাঝে আজ থেকে একশত ছয় বছর পূর্বে মহান আল্লাহর সাহায্যে যে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই খেলাফত ব্যবস্থা আজও টিকে আছে এবং শুধু টিকেই নেই সারা বিশ্বে প্রতিদিন এর প্রভাব বিকাশ করে বিশ্বের ২০৪ টি দেশকে আত্মস্থ করে নিয়ে দিন দিন এটি উন্নতির পথে ধাবমান রয়েছে। এ খেলাফতকে ধ্বংস ও অকার্যকর করার জন্য ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর করুনার ছায়ায় যার অবস্থান, একে ধ্বংস করে এমন সাধ্য কোন মানবীয় শক্তির নেই।
আমাদের ওপরে আল্লাহ তা’লার অসীম করুনা, তিনি আমাদেরকে খেলাফতের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়ার তৌফীক দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। আজ এই ঐশী খেলাফতের গুরুত্বকে উপলব্ধি করে এক মাত্র আহমদীয়া মুসলিম জামাতই পেরেছে সমগ্র বিশ্বে শান্তির বার্তা ছড়াতে। আজ আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের ৫ম খলীফার বরকতে আহমদী মুসলমানরা সারা পৃথিবীর মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন লা শরীক আল্লাহর বাণী। ইলাহী আলোয় আজ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সত্যিকারের ইসলাম। আজ খেলাফতের মর্যাদাকে উপলব্ধি করে বনী আদমের প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হচ্ছে ঐশী প্রেম। ঐশী ডাক আজ উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর কণ্ঠে। বিশ্ব যেন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় সেজন্য নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ (আই.) বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধের আহŸান জানিয়ে শান্তির বার্তা পাঠিয়েছেন। হায়! যদি তারা এই ঐশী ইমামের আহ্‌বানে সাড়া দিয়ে দেশ পরিচালনা করতো তাহলে অবশ্যই বিশ্ব হতো শান্তিময়।

খলীফাকে সাহায্য করেন আল্লাহ: বিরুদ্ধবাদীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে খলীফাকে ঐশী সাহায্যে জয়ী করেন। আল্লাহ কর্তৃক খলীফার পবিত্রকরণ ক্ষমতা: আরবের বন্যতুল্য মানুষ যেভাবে মহানবী (সা.) এর পবিত্রকরণ শক্তির প্রভাবে ফেরেশতা তুল্য হয়ে যান, ঠিক একইভাবে আহমাদীয়া মুসলিম জামা’তের খলীফাদের কল্যাণে কোটি কোটি পথহারা মানুষ সঠিক পথ লাভ করে, আল্লাহ প্রেমিকে পরিণত হয়েছেন। প্রতি শুক্রবার সবাই যুগ খলীফার খুতবা শুনার জন্য এমটিএ-এর সামনে বসে থাকেন তিনি কি উপদেশ দেন আর তা সাথে সাথে বাস্তবায়ন করার জন্য মনে প্রাণে লেগে যান। কারণ খলীফা হলো খোদাপ্রদত্ত এক বিশেষ নিয়ামত ও আল্লাহপাকের সানিধ্যে পৌঁছার আলোকোজ্জ্বল এক পথ এবং আত্মার উৎকর্ষ সাধনের একমাত্র উপায়।  

খেলাফত আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের মাধ্যম:
এ সম্পর্কে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)- বলেন, “আমার মতে ইসলামে এই বিষয়টি একাংশের প্রাণ স্বরূপ। ধর্মের ব্যবহারিক দিক নানাভাবে বিভক্ত। ধর্মের যে অংশের সাথে এই বিষয়টির সম্বন্ধ, তা হলো জাতির একতা। কোন জামা’ত, কোন জাতি, ঐ পর্যন্ত উন্নতি করতে পারে না, যে পর্যন্ত একাকার রূপে তাতে ঐক্য পাওয়া না যায়। মুসলমানদের, জাতি হিসেবে তখনই পতন ঘটেছে যখন তাদের মধ্যে খেলাফত থাকে নাই। যখন খেলাফত থাকল না, তখন উন্নতিও বন্ধ হয়ে গেল। একতা ছাড়া উন্নতি হতে পারে না। উন্নতি একতা দ্বারাই সম্ভবপর। রূহানী খেলাফত ছাড়া ইসলাম কখনো উন্নতি করতে পারে না, সর্বদা খলীফাদের মাধ্যমেই ইসলাম উন্নতি করেছে এবং ভবিষ্যতেও এর দ্বারাই উন্নতি করবে। সর্বদা খোদা তা’লাই খলীফা নিযুক্ত করে এসেছেন এবং ভবিষ্যতেও খোদা তা’লাই খলীফা নিযুক্ত করবেন”। (তথ্যঃ পাক্ষিক আহমদী, ৩০ জুন ১৯৬২)।  

খেলাফতের কল্যাণ:
হযরত রসূলে করীম (সা.)-এর সাহাবারা (রা.) জানতেন যে সকল কল্যাণ এই খেলাফতের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তাই তাঁরা হযরত রসূল করীম (সা.)এর ওফাতের পর খলীফা মনোনীত করে খলীফার হাতে বয়াত করে সেই মহান কল্যাণের চাদরে আবৃত হোন। খেলাফত যদি ঐশী কল্যাণ না হতো তাহলে কি রসূলে করীম (সা.)-এর পবিত্র দেহ মোবারক দাফন করার পূর্বেই এই খলীফা নির্বাচন করতেন? অবশ্যই না। এতে সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলেই তাঁরা (রা.) প্রথমেই খলীফা নির্বাচন করে একক নেতৃত্বের কথা মেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিলেন। কিন্তু মুসলিম জাতির দুর্ভাগ্য! এই মহান কল্যাণ থেকে মাত্র ৩০ বছর পরেই বঞ্চিত হয়ে গেল। তারা খেলাফত হারিয়ে ফেললো, কিন্তু হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের সেই ভবিষ্যদ্বাণী ‘সুম্মা তাকুকুন খিলাফাতুন আলা মিনহাযিন নবুওয়াত” [অর্থাৎ ইমাম মাহদী (আঃ) এর মাধ্যমে] এরপর নবুয়তের পদ্ধতিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সেই ‘খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়ত’এর যুগে খেলাফতের সবচেয়ে বড় কল্যাণ ইসলামের পুনরায় বিজয় লাভ করার দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখবার অপেক্ষায় ছিল। আল্লাহ তা’লা হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে দেয়া সেই সুসংবাদ অনুযায়ী তাঁর খাদেম ও সেবক ও খলীফাতুল্লাহ্ হযরত ইমাম মাহদী ও মসীহ্ মাওউদ আলায়হেস সালামকে প্রেরণ করলেন। যার কাজ হলো সমগ্র বিশ্বাসীকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে একত্রিত করা। আজ তাঁরই ৫ম খেলাফত কাল চলছে।

এই যে আহমদীয়া মুসলিম জামাতে মহান খোদা তা’লা ও তাঁর রসূলের কথা অনুযায়ী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন এটা কি ইসলামের জন্য এক মহান কল্যাণ নয়? যে কল্যাণ থেকে বিশ্ববাসী এতদিন বঞ্চিত ছিল সেই কল্যাণ লাভের আবার সুযোগ করে দেওয়া, এতে কি আমাদের সেই মহান খোদার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয়?
খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগ আমাদের সামনে রয়েছে, আমরা পবিত্র কুরআনের প্রত্যেকটি অঙ্গীকারকে পূর্ণ হতে দেখি। মহানবী (সা.)-এর মিশনকে পুনরায় আল্লাহ তা’লা আহমদীয়া খেলাফতের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আর কোটি কোটি হৃদয় আজ হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের কালেমা উচ্চারণ করে ইসলামের পতাকা তলে একত্রিত হচ্ছেন। এটি কি খেলাফতের কল্যাণ নয়?

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) যখন আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে সংবাদ পেয়ে ঘোষণা করলেন যে, আমি সেই খলীফাতুল্লাহ্। যখন তিনি এই ঘোষণা দিলেন, আর তখনই ভারতের সমস্ত ইসলাম বিরুধী শক্তি একত্রিত হয়ে গেল, খৃষ্ট্রীয় শক্তি, আর্য সমাজ, হিন্দু সমাজ সকলে সম্মিলিত ভাবে এই ব্যক্তির উপর আক্রমণ করল এবং এই দাবী করলো যে, একে মিটিয়ে দিব। এর নাম নিশানা পর্যন্ত শেষ করে দিব। কিন্তু তিনি (আ.) বলেন, আমি দৃঢ়তা এবং সংকল্পের সাথে বলছি, আমি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। খোদার কৃপায় এ ময়দানে আমারই জয় হবে। কেমন ছিল সেই ব্যক্তি যাকে কেউ চিনতো না, জানতো না, আর তিনি নিজেকে প্রকাশ করতেও চাননি, কিন্তু খোদা দাঁড় করিয়ে বলছেন, তুমি আমার তরফ থেকে মনোনীত সেই খলীফা। আজ আমরা দেখি কোথায় সেই খৃষ্ট সমাজ, কোথায় সেই হিন্দু সমাজ আর কোথায় সেই মোহাম্মদ হোসেন বাটালোভী। যারা চেয়েছিল খলীফাতুল্লাকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা আজ কোথায়? তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে গেছে। আর খোদার ওয়াদা অনুযায়ী তার খেলাফতকে চিরদিনের জন্য সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন, হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর মাধ্যমে। হযরত মসীহ মাউদ (আঃ)-ইন্তেকাল করলেন, ১৯০৮ মনের ২৬ মে, আর ২৭ মে খোদা তা’লার ওয়াদা অনুযায়ী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হল। খেলাফতের কল্যাণের ধারাকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র করা হয়। ১৯৭৪ সনে আহমদীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো এই ঘোষণা দেয় যে আহমদীয়াতকে দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দিব। আহমদীদের হাতে কি আছে? কিছুই তাদের হাতে নেই। সংখ্যার দিক থেকেও তারা অনেক কম। তাদেরকে মিটিয়ে দেওয়া কোন ব্যাপার না। হ্যাঁ, তাদের হাতে থাকতে পারে অনেক বড় বড় অস্ত্র, বড় বড় নেতা, তাদের হৃদয়ে কত অহংকার যে আমরা কত শক্তিশালী। আমাদের সাথে লড়ার সাহস কার আছে?

আজ বিশ্ববাসী চিন্তা করে দেখুক, কোথায় জুলফিকার আলী ভুট্টো আর কোথায় আহমদীয়া মুসলিম জামাত। আজ জুলফিকার আলীর নাম পৃথিবীর কতটি দেশে ছড়িয়ে আছে? পৃথিবীর কতজন তাকে চিনে? আর কোথায় আজ জামাতে আহমদীয়া পৌঁছেছে? এটাকি খেলাফতের মহান কল্যাণ সমূহের মধ্যে থেকে একটি কল্যাণ নয়?
পাকিস্তানের সরকার ১৯৮৪ সালে এই অর্ডিন্যান্স জারি করলেন যে, আহমদীরা কালেমা উচ্চারণ করতে পারবে না। নামাজ পড়তে পারবে না, সালাম দিতে পারবে না, কোন ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান তারা পালন করতে পারবে না। এর সাথে এই কথাও বললো যে আহমদীরা হল ক্যান্সার। তাদেরকে এই দুনিয়া থেকে এবং এর মূলকে মিটিয়ে দেওয়া হবে। আর কে বলেছিল এই কথা? কোন সাধারণ মানুষ নয়, শক্তিশালী ক্ষমতাধর জেনারেল জিয়াউল হক। যার হাতে ছিল অনেক উন্নত মানের শক্তি। আর তার মোকাবেলায় জামাতে আহমদীয়ার খলীফার হাতে কি শক্তি ছিল? এই জামা’তের কাছে কোন্ শক্তি ছিল?

কিন্তু জেনারেল জিয়াউল হক জানতো না যে জামাতে আহমদীয়ার খলীফা সেই শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, যার সাথে খোদা ছিলেন। সেই কথা যা মুহাম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম বলেছেন “ইয়াদুল্লাহে ফাও কাজ জামআ” অর্থাৎ জামা’তের উপর খোদার হাত আছে। কোথায় সেই জিয়াউল হক। আর কোথায় আজ জামাতে আহমদীয়া? যাকে ক্যান্সার বলা হয়েছিল সে জামাত আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। একটু ভেবে দেখুন। পাকিস্তান সরকার যখন এই অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল তখন হযরত মির্যা তাহের আহমদ (রাহে.) বলেন, আজ যখন কালেমার উপর এই নাপাক হামলা করা হয়েছে। তাই আমি ইসলামী জাহানকে সম্বোধন করে বলছি, আজ প্যালেস্টাইনের প্রশ্ন নয়, আজ জেরুজালেমেরও প্রশ্ন নয়, আজ মক্কার প্রশ্ন নয়, আজ ঐ এক অদ্বিতীয় খোদার ইজ্জত ও প্রতাপের প্রশ্ন, যার নামের দরুন এই মাটির শহরগুলো মর্যাদা লাভ করেছিল। আর আজ তার তৌহীদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তবলীগের যে জ্যোতি মৌলা আমাদের অন্তরে জেলেছেন এবং আজ সহস্র সহস্র অন্তরে যে শিক্ষা প্রজ্জলিত তা নিভাতে দিবে না, এক অদ্বিতীয় খোদার কসম এটিকে নিভাতে দিবে না। এই পবিত্র আমানতের হেফাযত করুন। আমি মহামহিমান্বিত খোদার নামে শপত করে বলছি যদি আপনারা এই আমানতের বিশ্বস্ত হয়ে যান তা হলে খোদা তা’লা এটিকে কখনও নিভতে দিবে না। এর শিক্ষা উন্নত ও উচ্চতর হতে থাকবে ও বিস্তার লাভ করবে। এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়কে ক্রমাগত আলোকিত করে বাড়তে থাকবে। এবং সমগ্র ভু-পৃষ্ঠকে ঘিরে ফেলবে, সমস্ত অন্ধকারকে আলোক মালায় পরিবর্তিত করবে। একদিকে জেনারেল জিয়াউল হকের সমস্ত শক্তি অপর দিকে এই দুর্বল ব্যক্তির আহ্বানে লক্ষ লক্ষ আহমদী এই খেলাফতের ডাকে সাড়া দিল। আর সমস্ত দুনিয়ায় হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের দ্বীনকে হাতে নিয়ে ঢলে পড়ল, যার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত কয়েক বছর পূর্বে আমরা লন্ডন জলসার সময় দেখেছি। বিভিন্ন দেশের রাজাদেরও রাজা আজ এই ঐশী খেলাফতের পতাকা তোলে আশ্রয় নিচ্ছেন। এই সব দৃষ্টান্ত কি খেলাফতের কল্যাণ নয়? এক বছরেই লাখ লাখ এবং কোটি পর্যন্ত এই খেলাফতের রজ্জুকে আকড়ে ধরে শান্তির নীড়ে প্রবেশ করছে। কোটি কোটি হৃদয় আজ এক খোদার ইবাদত করছে এবং এক খলীফার নেতৃত্বে, এটা কি খোফতের বরকত ও কল্যাণ নয়?

হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহে.) বলেছিলেন, “খেলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পৃথিবীতে তৌহীদ প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আল্লাহ্ তা’লা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন খেলাফত প্রতিষ্ঠার এবং এর সুফল লাভের জন্য এর প্রতিষ্ঠা অটল ও নিশ্চিত। আহমদীয়া জামা’তের মাঝে খেলাফত চির সবুজ ও চির প্রবহমান সুগন্ধ ছাড়ানোর মত জিনিস। এটি এমন গাছ যার শিকড় অত্যন্ত দৃঢ়, কোন ঝড় বৃষ্টি একে উপড়ে ফেলতে পারবে না। এটি এমন গাছ যার সব সময় বসন্ত কাল বিরাজ করে! কখনই পাতা ঝরে পড়ে না। সব সময় টাটকা পাকা ফল পাওয়া যায়।” (আলফযল ৬ ফেব্রæয়ারী ২০০১)

সমগ্র বিশ্বে আজ পর্যন্ত কোন ফের্কা পারেনি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা ইসলাম প্রচার করতে। কিন্তু একমাত্র আহমদীয়া মুসলিম জামাত আল্লাহর কৃপায় তা করে দেখিয়েছেন MTA-এর মাধ্যমে, বর্তমান আরব বিশ্বের জন্য MTA-এর পৃথক চ্যানেল MTA-3 চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে এই প্রচার মাধ্যম চালু রয়েছে। এ সব কি খেলাফতের কল্যাণ নয়?

যেখানে সর্বপ্রথম ৪০ জনের বয়াতের হিসাব হয়েছিল আর আজ খোদা তা’লা কোটি কোটিতে পরিণত করে দিয়েছেন। যেখানে একটি গ্রামে আহমদীয়া জামাত ছিল আর আজ ২০৪টি দেশে হাজার হাজার আহমদী জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ আহমদীয়া জামা’তের যে ক্রমশ উন্নতি দেখতে পাচ্ছি তা কিসের ফলে? এই অসাধারণ উন্নতি একমাত্র খেলাফতের বরকতের এবং কল্যাণের ফলেই হয়েছে। কারণ যার দায়ীত্বভার স্বয়ং খোদা তা’লা গ্রহণ করেছেন। আজ আমরা সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যাদের আমলকে খোদা তা’লা কবুল করেছেন। আজ আমরা সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যাদের আমলে সালেহ্কে খোদা তা’লা স্বীকৃতি দিয়েছেন। যার প্রথম নেয়ামত খেলাফতের কল্যাণ আমাদের দান করেছেন।

আজ আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের খলীফার নেতৃত্বে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পবিত্র কুরআন সম্পূর্ণ অনুবাদ করে পথ হারাদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পবিত্র কুরআন মাজিদ প্রায় শতাধিক ভাষায় অনুবাদ করে কোটি কোটি হৃদয়কে আল্লাহর বাণী বুঝার সুযোগ করে দেওয়া কি খেলাফতের কল্যাণ নয়? আজ সমগ্র বিশ্বে কোটি কোটি মুসলামান রয়েছে। কিন্তু তাদের কোন নেতা নেই। যিনি সবার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহর নিকট চাইবেন, জাতির দুঃখে পাশে এসে দাঁড়াবেন। আজ এই সৌভাগ্য কার? শুধুমাত্র জামাতে আহমদীয়ারই রয়েছে। কারণ খোদার ওয়াদা এখানে পূর্ণ হয়েছে। আজ ঐশী খলীফা ঢাল হয়ে আমাদেরকে হিফাযত করছেন। শত্রু পক্ষের সমস্ত তীরকে নিজের বুকের মধ্যে নিচ্ছেন। আর আমাদেরকে আরাম দিচ্ছেন। আজ আমরা হাজার হাজার চিঠি লিখছি তাঁর কাছে, আর তিনি বলছেন পত্র পাওয়ার আগেই আমি তোমাদের জন্য দোয়া করছি। আমাদের জন্য দোয়ার এক ভান্ডার রয়েছে। আজ আমরা দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমাদের হৃদয়ে কমছে কম এই বিশ্বাস রয়েছে যে, আমাদের এক আধ্যাত্মিক নেতা আছেন, যার কাছে দোয়ার জন্য বলবো আর তিনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আজ যদি দুনিয়ার এক প্রান্তে কোন এক আহমদী কষ্ট পায় তো খলীফায়ে ওয়াক্তের হৃদয় সেই কষ্টে ব্যথিত হোন এবং তিনি আল্লাহর দরবারে কাঁদেন। আল্লাহ তাঁর দোয়াকে কবুল করেন।

ঐশী ইমাম যে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে দোয়া করেন অন্য কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়:
হযরত মুসলেহ মাওউদ (রা.) বলেছেন, “তোমাদের জন্য একজন আছে, যার হৃদয়ে তোমাদের জন্য ব্যথাবোধ আছে, যিনি তোমাদেরকে ভালবাসেন। তিনি তোমাদের দুঃখে দুঃখিত হন। তোমাদের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করেন এবং খোদার দরবারে দোয়া করেন”। (মনসবে খেলাফত; পৃ: ৫) হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহে.) একবার মজলিসে শূরার সমাপ্তি দোয়ার পূর্বে বললেন, “আমি কি বলে প্রকাশ করব? আমার অন্তর আপনাদের মঙ্গল কামনায় কতটা ব্যাকুল আমি তা প্রকাশ করতে অক্ষম। আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু, আমার অস্তিত্বেও প্রত্যিটি রন্ধ্র আপনাদের কল্যান কামনায় নিবেদিত। আপনাদের পক্ষ থেকে যেকোন সুখবর, যেকোন খুশির খবর আমার জন্য নবজীবনের বার্তা বহন করে আনে।” (মাসিক পত্রিকা, পরিশিষ্ট তাহরীকে জাদীদ রাবওয়াহ-এপ্রিল ১৯৮৭ইং)

হৃদয়ের কথা, হৃদয়ের ভাষা, ভালবাসার কথা, ভালবাসাপূর্ণ হৃদয়বানরা বোঝেন। প্রত্যেক আহমদী যারা যুগ খলীফার সাথে সম্পর্ক রাখেন তারা বুঝে, হুযূর (আই.) কত ভালবাসেন একজন আহমদীকে। অন্যেরা তা বুঝবে না। এখানে যারা বসে আছেন তাদের মধ্য থেকে অনেকেই এমন আছেন যারা সমস্যা থেকে উদ্ধারের জন্য দোয়া চেয়ে হুযূরের কাছে লিখেছেন এবং হুযূরের দোয়ার বরকতে সেই সমস্যা দূর হয়েছে। হাজার হাজার দোয়া কবুলের ঘটনা প্রত্যেক খলীফার জীবনে ঘটেছে। আলহামদুলিল্লাহ্। অনেকেই বলেন, আমরা দোয়া করি কিন্তু দোয়া কবুল হয় না। আসলে আমাদের দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণীয় হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আল্লাহ প্রদত্ব খলীফার পরিপূর্ণ আনুগত্য করবো। এ প্রসঙ্গে হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহে.) বলেন, “আমার নিজ ব্যক্তিত্বের কোনই মূল্য নেই। আমার ভেতরের অবস্থা তো বলার মত নয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা যেহেতু খলীফা বানিয়েছেন, আমাকে খেলাফতের আসনে বসিয়েছেন, তাই যে আহমদীর অন্তরে খলীফার জন্য ভালবাসা নাই, অথবা মাকামে খেলাফতের সাথে প্রকৃত ভালবাসা নাই, তাহলে যুগ খলীফার দোয়া ও তার পক্ষে কবুল হবে না। সুতরাং মৌখিকভাবে এবং বাস্তবিক অর্থে খলীফার আনুগত্য একান্ত জরুরী। আল্লাহ্ তা’লা তারই দোয়া কবুল করেন যে প্রকৃত অর্থে খেলাফতের সাথে বিশ্বস্ততা রক্ষা করে” (আল ফযল, ২৭ জুলাই, ১৯৮২)।

আমাদের সৌভাগ্য যারা এ ঐশী খেলাফতের অধিনে থেকে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছি, এ জন্য আমাদেরকে আল্লাহ তা’লার দরবারে অনেক বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। যেভাবে আল্লাহ্ ত’লা সূরা ইব্রাহীমের ৮নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তাহলে নিশ্চয় তোমাদেরকে আরও অধিক দান করবো। কিন্তু যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও তাহলে (জেনে রেখ) আমার আযাব বড়ই কঠোর”। তাই আমাদেরকে মনে রাখা দরকার খেলাফত একটি মহা পুরস্কার। এজন্য যারা এ পুরস্কারের অকৃতজ্ঞা করবে তারা দুষ্কৃতিপরায়ণ হবে। এ নেয়ামতের কদর করে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। যা পালন করা একান্ত কর্তব্য। যেমন যুগ খলীফার সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলা, তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। জুমুআর খুতবা সরাসরি শ্রবণ করা। ক্রন্দনরত দোয়া ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। আমাদের সন্তানদেরও জীবনের প্রারম্ভেই নেক কাজের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা, নিত্যদিন কুরআন তেলাওয়াতসহ পাঁচওয়াক্ত নামায আদায়ে অনুরাগী করাসহ যুগ খলীফার সকল আদেশকে এমন ভাবে মান্য করা যেমন এর চেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ আর কিছু নাই। সবেচেয়ে মূল্যবান জিনিস যেন যুগ খলীফার আদেশের সামনে তুচ্ছ মনে হয়। আমরা যদি যুগ খালীফার সকল নির্দেশ গুলোর উপর শতভাগ আমল করে চলি তাহলেই আমাদের দায়ীত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করেছি বলে বিবেচিত হবে। তাই যুগ খলীফার বিভিন্ন তাহরিকে যদি আমরা লাব্বায়েক বলে সাড়া দেই তবেই না আমরা আল্লাহ্ তা’লার প্রিয় ভাজন হতে পারবো। যারা খলীফার আনুগত্য না করে জামাতী নেযামের বাইরে চলে যায় তাদের পরিণাম ভয়াবহ। যেভাবে হযরত নবী করীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে জামা’ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে সে জাহান্নামে পড়েছে। মূলত: এটি তৌহীদের প্রতিফলন বা বিকাশ যে, আল্লাহ্ তা’লা মানব জাতিকে একজন ইমামের হাতে একত্রিত করে রাখতে চান।

সৈয়্যদনা হযরত মুসলেহ মাওউদ (রা.) বলেছেন, “এমন ব্যক্তি এ জামা’তের জন্য উপকারে আসতে পারবে যে নিজেকে তার ইমামের সাথে সম্পৃক্ত রাখবে। যে ব্যক্তি তার ইমামের সাথে সম্পর্ক রাখবে না সে যত বড় জ্ঞানী হোক না কেন, পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের অধিকারীই হোক না কেন, সে ততটা কাজও করতে পারবে না যতটা একটি ছাগল ছানাও করতে পারে”। (আল ফযল; ২০ নভেম্বর, ১৯৪৬ইং)

পরিশেষে এটাই বলবো, খিলাফত হলো সেই চুম্বক যা আল্লাহ্ তা’লার দয়া ও করুণাকে আকর্ষণ করে। খেলাফতই হলো আল্লাহ্র রজ্জু, খেলাফতই হলো আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য লাভের ঐশী পথ, খেলাফতই হলো ঐশী প্রতিশ্রুতি পূর্ণতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন, খেলাফতই হলো আত্মরক্ষার ঐশী ব্যবস্থাপনা, খেলাফত হলো শান্তি ও নিরাপত্তার বলয়, খেলাফত হলো মহান পুরষ্কার-“আজরান আযীম” (৪৮:৩০) আর এরই জন্য খেলাফতই হলো জান্নাত। তাই আসুন, আল্লাহ্ তা’লা প্রদত্ত ঐশী নেয়ামত খেলাফতের এই রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে আমরা আহমদীয়া খেলাফতের পঞ্চম খলিফা হযরত মির্যা মাসরুর আহমদ (আই.)-এর সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষায় নিজেদেরকে পরিপূর্ণভাবে তাঁর সমীপে সমর্পণ করে ইহজীবনেই জান্নাতের স্বাদ পেয়ে ধন্য হই। আল্লাহ্ আমাদের এই একাগ্র বাসনাকে পূর্ণতা দান করুন। আর আজও যারা এই ঐশী খেলাফতের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি তারাও যেন অতি দ্রুত এতে সামিল হয়ে যায়। আর যারা না বুঝার কারণে এই খেলাফতের বিরুধীতা করছে তারাও যেন বুঝতে পারে। আল্লাহ তা’লা এমনই করুন। আমীন।

মাহমুদ আহমদ সুমন

 

Read more in English: 

Blessings of Khilafat

The Importance of Khilafat

More resources on Khilafat

By |2014-04-12T03:00:25+00:00April 9th, 2014|Ahmadiyyat, Khilafat|0 Comments

About the Author:

Leave A Comment