ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান

//ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান

ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান

ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…’। ১৯৫২ সালের এই মাসের ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এ দাবিতে বাঙালিরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন পাকিস্তানিরা তার জবাব দিয়েছিল বুলেটের মাধ্যমে। বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। সেই রক্তের ছোঁয়া পেয়ে আশ্চর্য দ্রুততায় গোটা জাতি জেগে উঠেছিল তার শেকড়ের টানে। পাকিস্তানিদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোনো বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই। রক্তের বিনিময়ে এ বাংলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। একঝাঁক থোকা থোকা নাম সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো অনেকের জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার ভাষা, স্বকীয়তা এবং গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের স্বীয় মাতৃভাষার মর্যাদা যেমন অপরিসীম, তেমনি আল্লাহতাআলার কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়। তিনি সব ভাষা জানেন, বোঝেন। যে যেভাবেই তাকে ডাকে না কেন, তিনি বোঝেন, উত্তর দেন, তার সঙ্গে কথা বলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি, যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমার কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে’ (সুরা ইব্রাহিম, আয়াত : ৪)। সব জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গম্বর এসেছেন, তেমনি সব জাতির নিজ নিজ ভাষাতেই আল্লাহতাআলার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে। আল্লাহতাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযত মর্যাদা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব অথবা কিতাববিহীন প্রত্যাদিষ্টকে ওহি দ্বারা পাঠিয়েছেন। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতাআলার বিশেষ কৃপা। আর না হয় মানুষ ভাষার মর্যাদা বুঝত না। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সঙ্গে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশসমূহের ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতাও। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (সুরা আর রুম, আয়াত : ২২)। ভাষা ও রঙের এই বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আকাশ-মালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি। বর্ণের ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। তবু এই বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। আর মানবতার এই ঐক্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে, সৃষ্টিকর্তাও একজনই। মানবজাতির সূচনালগ্নে ভাষা ছিল একটিই এবং তা ছিল ইলহামি ভাষা। এরপর মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে এলাকা এলাকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবেই সূচনাতে মানুষের রঙও ছিল একই রকম। এরপর গ্রীষ্ম, শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুযায়ী তার রঙেরও পরিবর্তন হতে থাকে। আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা, কেউ যদি ভাবেন যে, বাংলায় আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি কি তা শুনবেন? এর উত্তরে বলা যায় অবশ্যই আল্লাহপাক শুনবেন, কেননা তিনি বলেছেন, সব ভাষাই তার সৃষ্ট এবং সব ভাষাতেই নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভাষাই আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদার দিক থেকে কম নয়। আর এ জন্য সবাই নিজ নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য পায়। কিন্তু বড় কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি আমার প্রিয় মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে। আমরা আজ এতই আধুনিক হয়ে গেছি যে, মাতৃভাষায় কথা বলতেও নাকি লজ্জা লাগে। এফএম রেডিওগুলোয় শোনা যায় একটি বাক্য বাংলা বললে সঙ্গে চারটি বাক্য বলে অন্য ভাষায়, এটার নামই কি আধুনিকতা? অথচ আল্লাহপাকের কাছে সব ভাষার মর্যাদা সমান। আমরা কি পারি না সর্বত্রে আমাদের দেশমাতৃকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে? আমাদের ওয়াজ-নসিহতগুলো হবে মাতৃভাষায়, আমাদের জুমার খুতবা হবে নিজ ভাষায়, নামাজে নির্ধারিত দোয়ার পর নিজ ভাষায় আল্লাহপাকের কাছে মন খুলে কিছু চাইতে কি পারি না?
আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব না দিই, তাহলে আল্লাহপাকের দরবারেও আমাদের কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে না। কেননা বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীর রয়েছে অবদান। আমাদের সবার দায়িত্ব, আমাদের লেখায়, কথায়, চলনে-বলনে মাতৃভাষাকে আরও বেশি করে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা, আমাদের ভাষাকে এমন সুন্দর ও মাধুর্যের সঙ্গে ত্রুটিহীনভাবে উপস্থাপন করতে হবে; যাতে কেউ এর কোনো ত্রুটি খুঁজে না পায়। আমরা যদি আমাদের ভাষাকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং জুমার খুতবাগুলোতে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর ও মাধুর্যতার সঙ্গে উপস্থাপন করতে পারি তবে অন্যরাও এর প্রতি আসক্ত হতে বাধ্য। এ মাসে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেসব বীর শহীদ ও বীর সৈনিকের, যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন। শহীদ দিবস উপলে আমরা প্রতিবারের মতো এবারও একুশের শহীদদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে নিজ ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

See more at: http://www.dainikamadershomoy.com/2016/02/21/74564.php#sthash.s6mvYUsF.dpuf

By |2016-02-24T01:24:32+00:00February 24th, 2016|Islam|Comments Off on ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান

About the Author: